July 21, 2025, 8:57 pm


অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

Published:
2025-07-21 15:47:40 BdST

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের যান্ত্রিক উইংস এরকারখানা বিভাগ যেন দুর্নীতির আঁতুড়ঘর


ছবি: সংগৃহীত

অনিয়ম ও দুর্নীতির ভয়াল থাবায় জেঁকে বসেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের যান্ত্রিক উইংস এর কারখানা বিভাগ। ভুয়া টেন্ডার, ঘুপচি টেন্ডার, মালামাল না কিনে ভুয়া ভাউচার দিয়ে বিল উত্তোলন, একই গাড়ীকে বিভিন্ন সময়ে মেরামতের নামে ভুয়া বিল বানানোর মতো ভুরি ভুরি অভিযোগ থাকার পরও এ বিভাগের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে দিন দিন কারখানা বিভাগ দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
বিগত পাঁচ বছরের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কোন কোন ঠিকাদার টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেছে এবং চূড়ান্তভাবে কোন কোন ঠিকাদার কার্যাদেশ পেয়েছে এ সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করলেই দুর্নীতির থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে। ফ্যাসিস্ট সরকারের ঠিকাদার সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি কারখানা বিভাগ। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট কাজ পেয়ে থাকে। কেন একই ঠিকাদার সিন্ডিকেট কাজ পায় এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর এক তথ্য যা সমস্ত দুর্নীতি ও অনিয়মকে হার মানিয়েছে। কারখানা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের সাধু হিসেবে আবির্ভুত করলেও নিচের দিকের কর্মচারীদের দিয়ে সমস্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দ্য ফিন্যান্স টুডে’র নিজস্ব অনুসন্ধান ও ঠিকাদারদের সাথে কথা বলে উদঘাটন করেছে দুর্নীতির মাস্টার মাইন্ডদের একটি তালিকা। যান্ত্রিক উইংস এর প্রতিটি বিভাগ যেন এক একটি দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। কারখানা বিভাগের দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় আজ প্রকাশিত হলো ১ম পর্ব।

পিআরএল-এর কর্মচারীরা নিয়মিত কাজ করছে কারখানা বিভাগে

কেস স্টাডি
১. শামীম-পদবী-মেকানিক/কারখানা বিভাগে কর্মরত। অনেক পূর্বেই পিআরএল শেষ করেছেন। কিন্তু যথারীতি সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করছে কারখানা বিভাগে। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরেও তিনি কারখানা বিভাগে কিভাবে নিয়মিত কাজ করে থাকেন। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী পিআরএল শেষ করার করার পরও ডিউটি করতে পারে কি না এ ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বলেন তিনি যোগদান করেই তাদের এখানে পেয়েছেন। কিন্তু শামীম কি বিনা বেতনে এখানে রাত-দিন কাজ করছে? এ ব্যাপারে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোন অনুমোদন নাই।
২. মো. মোবারক-পদবী-অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস তৈরি করে থাকেন। তিনিও বহু পূর্বে পিআরএল-এ গিয়েছেন। কিন্তু নিয়মিত চাকরির মতো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস করছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তার ব্যাপারেও নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের বক্তব্য একই। এরা মাঝে মধ্যে আসে। কিন্তু দ্য ফিন্যান্স টুডে’র হাতে রক্ষিত তথ্য ও প্রমাণ বলছে মোবারক নিয়মিত অফিস করে থাকে। পিআরএল শেষ করেছে বহু পূর্বে তার পরেও কিভাবে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ দৈনন্দিন কাজ করছে। এ প্রশ্নের উত্তর মিলেনি। নেই কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। তার বেতন হয় কোথা থেকে। তিনি সরকারি নিয়মিত চাকরির সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন কিভাবে? পিআরএল কত তারিখে শেষ হয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন আমাকে দেখে বলতে হবে। এরপর তিনি (নির্বাহী প্রকৌশলী) আর ফোন ধরেন নি।
৩. মো. বাতেন-পদবী-অফিস ক্লার্ক। তিনিও পিআরএল-এ গিয়েছেন। বাতেন এর ভাষ্য অনুযায়ী এ বছরের শেষের দিকে তার পিআরএল শেষ হবে। পিআরএল থাকা অবস্থায় কিভাবে নিয়মিত অফিস করছেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্যারদের কথা অনুযায়ী আমি নিয়মিত অফিস করছি। বাতেন এর কার্য তালিকায় রয়েছে কারখানা বিভাগের ক্ল্যারিক্যাল কাজ-টেন্ডার ও বিল প্রদান। বাতেন আরও বলেন শামীম ও মোবারক নিয়মিত অফিস করছে। তার বক্তব্য, ভয়েস রেকর্ড ও কাজের প্রতিদিনের তথ্যচিত্র দ্য ফিন্যান্স টুডে’র হাতে রয়েছে।
শুধু মোবারক, বাতেন ও শামীম-ই নয় কারখানা বিভাগের দীর্ঘ ৩০ বছর একই চেয়ারে কাজ করে বড় বাবু হিসেবে খ্যাত আবদুল মালেক ভূঁইয়া উচ্চমান সহকারি পদে পদোন্নতি পাওয়ার পরেও গত ২৯/১২/২০২৪ তারিখ থেকে বর্তমান (জুলাই-২০২৫) পর্যন্ত অবৈধ ক্ষমতার জোরে কারখানা বিভাগে কর্মরত থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের চারণভূমিতে পরিণত করে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার ভুয়া বিল-ভাউচার ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের সাথে লুটপাট করে কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ঢাকাতে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে দ্য ফিন্যান্স টুডে’র অনুসন্ধানে এ তথ্য বের হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি প্রাপ্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগে সংযুক্ত হয়েছে। তার অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের তালিকা ধারাবাহিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হবে।
এ রকম আরও অসংখ্য মালেক ভূঁইয়া রয়েছে বিভিন্ন বিভাগজুড়ে। আমাদের অনুসন্ধানে ডজনখানেক মালেকরূপী কর্মচারীর সন্ধান মিলেছে। উঠে এসেছে তাদের অবৈধ সম্পদের তালিকা। যা দেখলে চোখ কপালে উঠবে। কিন্তু মালেক, বাতেন, মোবারক সৃষ্টির কারিগর নির্বাহী প্রকৌশলী , তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীগণ থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এদের ক্ষমতার জোর এত বেশি যে গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের ভয় দেখায়। অথচ এরা জানে না গণমাধ্যমের হাত অনেক শক্তিশালী। অবৈধ অর্থ ও প্রতিপত্তি দিয়ে সত্যকে চাপা রাখা যায় না। এমনও কর্মকর্তা রয়েছে যার আছে ২টি পাসপোর্ট যা আমাদের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে এমন চমকপ্রদ তথ্য ২টি পাসপোর্টের কপি, বিদেশ ভ্রমণের তথ্য ও উক্ত ব্যক্তি তার অর্জিত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করেছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে তারও একটি তালিকা দ্য ফিন্যান্স টুডে’র হাতে রয়েছে।
সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অযাচিত ও অবৈধ রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চেহারা উম্মোচন না করলে সমস্ত সংস্কার পরিকল্পনাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

সরকারি চাকরিতে পিআরএল (Post Retirement Leave) বা অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার পরে সাধারণত একই অফিসে নিয়মিত কর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ থাকে না, কারণ এটি মূলত চাকরি থেকে অবসরকালীন ছুটি হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন:

১. চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ (Contractual Appointment):
কোনো অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিশেষ দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার কারণে চুক্তিভিত্তিকভাবে আবার নিয়োগ পেতে পারেন। তবে এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের অনুমোদনের ভিত্তিতে হয় এবং এটি আলাদা নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।

২. পরামর্শক হিসেবে নিয়োেগ (Consultant):
অনেক সময় অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি সাধারণত প্রকল্পভিত্তিক বা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হয়।

৩. স্বেচ্ছাসেবক বা প্রশিক্ষক হিসেবে:
কেউ কেউ অবসরকালীন সময়ে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণমূলক কাজে স্বেচ্ছায় যুক্ত থাকতে পারেন, তবে এটিও অফিসের অনুমতির উপর নির্ভর করে এবং এটি সাধারণ চাকরি হিসেবে বিবেচিত হয় না।

সংক্ষেপে:
পিআরএল চলাকালীন নিয়মিত চাকরি করা যায় না।
বিশেষ অনুমোদন ও চুক্তির ভিত্তিতে অফিসে কাজের সুযোগ থাকতে পারে।

পিআরএল এ কর্মরত অবস্থায় নিয়মিত অফিসের কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারে কি না এ ব্যাপারে বক্তব্যের জন্য তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম (প্রশাসন) সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কে ফোন দিয়ে পাওয়া যায় নি। একইভাবে যান্ত্রিক উইংস এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জামাল উদ্দিনকে ফোন দিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একাধিক ঠিকাদার নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন শুধু কারখানা বিভাগ কেন পুরো যান্ত্রিক উইংস এর বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতির কালো ভূত বিরাজ করছে। এখানে যা বরাদ্দ পাওয়া যায় তার অর্ধেকই লুটপাট হয়ে যায়। নির্দিষ্ট একটি ঠিকাদার সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি এ যান্ত্রিক উইংস। এদের সহযোগিতা করছে দুর্নীতিবাজ কিছু প্রকৌশলী ও কর্মচারী।

 

 

 

 

 

 

 

 

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.