August 12, 2025, 11:15 pm


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-08-12 17:11:01 BdST

আজো তার চোখ খোঁজে ছোট ভাইকে


মায়ের অসুস্থতা এবং ছোট ভাইকে হারানোর শোক বুকে নিয়ে দেশের ক্লান্তি লগ্নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পিতাকে হারানোর পর ছোট আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে মায়ের আঁচলে বেড়ে উঠেন তারেক রহমান। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় জীবনের বেশি সময় কাটিয়েছেন নিপীড়ন আর নির্যাতন শিকার হয়ে। এখনো লন্ডনে বসে বিএনপির হাল ধরে রেখেছেন। ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর জন্য তার যে ভালোবাসা তা জনসম্মুখে প্রকাশ করেন না। তবে এখনো কাজের ফাঁকে ছোট ভাই কোকোর কথা মনে পড়ে আনমনা হয়ে যান। কাঁধেন অজরে। বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে ভাই হারানোর ব্যাথা। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তা কখনো প্রকাশ করেননা। শুধু মাত্র দেশের মানুষের স্বার্থসিদ্ধিই তার একমাত্র পরিকল্পনা।

দেশকে স্বয়ম্ভর ও সমৃদ্ধ দেখতে তখন তারেক রহমান ব্যাকুল। সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন চারণের মতো। কৃষিজীবী, শ্রমজীবী ও সম্প্রদায়গত পেশার মানুষকে দিয়ে চলেছেন পরামর্শ আর সাধ্যমতো সহযোগিতা। এরই এক পর্যায়ে গেলেন তিনি কক্সবাজারে। সমবেত হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে তিনি তাঁর কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করলেন। দিনটি ছিল পহেলা বৈশাখ। হঠাৎ এক কৌতূহলী সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘ভাইয়া, আপনি স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে এ ধরনের কর্মসূচির জন্য এই দিনটি কেন বেছে নিলেন?’ সেদিন হেসে হেসে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মতো লোকজনের নববর্ষ এভাবেই কাটবে। পুরো দেশটাই আমার কাছে একটি পরিবার বলে মনে হয়।

২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি তিনি ‘চ্যানেল আই’-এ একটি সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। অনুষ্ঠানটিতে দৈনিক মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করছিলেন। এক পর্যায়ে মতিউর রহমান চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন- সংসার কেমন চলছে? উত্তরে তারেক রহমান বললেন- “সংসার কিছু অভিযোগের পালায় চলছে। রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য এদিকেই সময় বেশি দিতে হচ্ছে। স্ত্রী-সন্তানের অভিযোগ- তাদের সময় দিতে পারছি না।” এসব ঘটনায় কারো মনে হতেই পারে, দেশের জন্য তাঁর যতো ভালবাসা, স্বজন-প্রিয়জনের প্রতি মমতাবোধ ততখানি নেই, এ রকম ধারণা কেউ করলে তা কিন্তু একেবারেই ভুল। দেশের ও দশের জন্য তিনি যেমন আকুলপ্রাণ, স্বজন-প্রিয়জনের জন্যও তেমনি মমতার সাগর। অপরিসীম মাতৃভক্তি, স্ত্রী-কন্যার জন্য হৃদয় উজাড় করা প্রেম ও মমতা, স্নেহধন্য ছোট ভাইয়ের জন্য অগাধ ভালবাসা, দেশের জন্য অন্তরের গভীর টান- সবকিছুই যেন সমানে সমান। স্নেহের ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর জন্য তাঁর যে অগাধ ভালবাসা- জনসমক্ষে তার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল। এর আগের রাতেই ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন আরাফাত রহমান কোকো। সে এক বর্বরোচিত ও বেদনাবিধুর ঘটনা। রাত তখন সোয়া ১১টা। একের পর এক গাড়ি এসে থামছে মঈনুল রোডের বাসার সামনে। গাড়ি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নামছে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। যৌথবাহিনীর প্রায় দু শতাধিক সদস্য গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলে। তখন বাসার ভেতরে ছিলেন দেশের তিন-তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো, তাঁর স্ত্রী শরমিলা রহমান, তাদের দু কন্যা সন্তান জাফিয়া ও জাহিয়া, তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও তাদের একমাত্র সন্তান জায়মা রহমান। দেশনেত্রী এ সময় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জায়মা, জাফিয়া ও জাহিয়া ছিল ঘুমিয়ে। ডা. জুবাইদা রহমান, আরাফাত রহমান ও শরমিলা রহমান নিজ নিজ কক্ষে ছিলেন।

ঠিক সেই সময় গাড়ির আওয়াজ ও বুটের শব্দে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এরপর শুরু হয় দরজায় ধাক্কাধাক্কি। বাসার দরজা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হলে প্রচন্ড আওয়াজ ও বুটের শব্দে গোটা বাড়িজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে ছিলেন যারা, সকলেই আঁৎকে ওঠেন। ভয়ে জড়সড়ো হয়ে শিশুরা কেঁদে ওঠে। বিশ্রামরত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই ভীতিকর পরিবেশে ছুটে আসনে বাড়ির প্রধান ফোটকের দিকে। তিনি জানতে চান- ‘কে আপনারা?’ জবাবে জানানো হয় তারা যৌথ বাহিনীর সদস্য, কোকোকে গ্রেফতার করতে এসেছেন। এ সময় বেগম খালেদা জিয়া তাদের উদ্দেশে বলেন- ‘কোকোকে নিতে এসেছেন ভাল কথা, দরজা ভাঙছেন কেন? এতোটা নির্যাতন চালানো ভাল নয়!’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, তাদের কাছে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে কিনা? থাকলেও এতো রাতে কেন? দিনের আলোয় আমার ছেলেকে ডাকলেও তো সে সময়মতো যথাস্থানে চলে যেতো। এরপর হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে পড়ে যৌথ বাহিনী। ভেতরে ঢুকেই তারা দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি গ্রুপের সদস্যরা আরাফাত রহমান কোকোকে বলেন, আমাদের সাথে যেতে হবে। বলার সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু হাসি দিয়ে বিনয়ী আরাফাত রহমান বিনা বাক্য ব্যয়ে যাবার প্রস্তুতি নেন। যৌথ বাহিনী তাঁকে নিয়ে যাওয়ার আগে আরাফাত রহমান মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করেন। এ সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আরাফাত রহমানকে গাড়িতে তোলার সময় তাঁর স্ত্রী-সন্তান, বড় ভাই তারেক রহমানের স্ত্রী-সন্তানের অঝোর কান্নায় রাতের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। যৌথ বাহিনীর আরেকটি গ্রুপ তল্লাশির নামে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। তারা আরাফাত রহমানের স্ত্রীকেও বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বাসা থেকে যাবার সময় তারা দুটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ও বেশকিছু কাগজপত্র নিয়ে যায়। আরাফাত রহমান কোকোর গ্রেফতারের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ওঠেন কারাবন্দি তারেক রহমান। তিনি তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছোট্ট একটি সেলে সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় অন্তরীণ। তাঁর কান্নার শব্দে ছোট্ট সেলটি যেন কেঁপে উঠছিল। দিনভর তিনি কেঁদেছেন। তাঁকে সাহস যুগিয়েছে, সান্ত্বনা দিয়েছে একই সেলে অপর বন্দি কবির। কারা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদপত্রে রিপোর্ট বেরিয়েছে যে, সারাদিন কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ-মুখ ফুলে গেছে।

কারা কর্তৃপক্ষ আরাফাত রহমান কোকোর গ্রেফতারের কথা তারেক রহমানকে জানাননি, তবে সেলে ছোট্ট একটি টেলিভিশন আছে, সেখানে কেবল বিটিভির অনুষ্ঠানমালা দেখা যায়। সেখানে সকাল এবং দুপুরের সংবাদে আরাফাত রহমান কোকোর গ্রেফতার হবার খবর প্রচার হয়েছিলো। তিনি টেলিভিশন দেখার আগেই অন্যান্য বন্দির কাছ থেকে খবরটি জেনেছেন। একমাত্র ছোট ভাই গ্রেফতার হওয়ার খবর তাঁকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকো পিঠাপিঠি দুই ভাই। তাঁরা পরস্পর বন্ধু ও খেলার সাথীও। তাঁরা এক সাথে স্কুলে গেছেন, এক সাথে খেলাধুলা করেছেন, আব্বা-আম্মার কাছে এক সাথেই অনুযোগ-অভিযোগ-দাবি নিয়ে হাজির হয়েছেন, এক সাথে বেড়াতে গেছেন।

সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনের জবানিতে পাওয়া যায়, এক সাথে দু ভাই হজব্রত পালন করতে গেছেন, এক সাথে দু ভাই স্ত্রী-কন্যাসমেত চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। দু ভাইয়ের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া, চমৎকার হৃদ্যতা। হবেই না-বা কেন? দু ভাই যে অভিন্ন সুখ-দুঃখের সাথী। বাবা শহীদ হবার পর শিশুকাল থেকেই দুজন অনেক বিপদ-আপদ, ঝঞ্ঝাবহুল ইতিহাসের সাক্ষী। কখনো বাবাকে দেখেছেন তাঁরা রণাঙ্গনে, কখনো দেখেছেন অগোছালো সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করতে, কখনো সেই সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে পিতার আটক হওয়া আর মুক্ত হওয়ার ঘটনা এবং একই বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে পিতার মর্মান্তিক শাহাদাতবরণের ঘটনারও তারা সাক্ষী। ছোট ভাইয়ের জন্য তারেক রহমানের যে কী অপরিমেয় স্নেহ-মমতা সেটা আরেকবার বোঝা গিয়েছিল আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি ইন্তেকাল করেন। সীমাহীন অপপ্রচার, অকথ্য অত্যাচার ও নির্মম-নির্যাতন চালানো হয় তাঁর ওপর। ভয়-ভীতি, হুমকি-ধমকিসহ নানারূপ মানসিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে হৃদরোগী বানিয়ে ছেড়েছিল মইন-ফখরুদ্দীন সেনাসমর্থিত সরকার। তার ফলেই চিকিৎসারত অবস্থায় বিদেশে তাঁর করুণ মৃত্যু ঘটে। মৃত্যু সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তারেক রহমান শোকে প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকটা সময় তিনি কোনো কথাই বলতে পারেননি। তারপর শুরু হয় তাঁর অন্তর্ভেদী হাহাকার, বুকফাটা কান্না। প্রিয় ভাইটির কথা মনে হলেই তাঁর অন্তর এখনো গুমরে কেঁদে ওঠে, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, নীরবে ও গোপনে অশ্রুপাত করেন

স্নেহের ছোট ভাইকে আজও আগলে রেখেছেন বুকের মধ্যখানে। ভাইয়ের জন্য এখনো থামেনি তাঁর কান্না। রাস্তা-ঘাটে, সভা-সমাবেশে, বিপণিকেন্দ্রে বা লোকালয়ে যেখানেই যান, আজও তাঁর চোখ খুঁজে ফেরে আরাফাত রহমান কোকোকে।

আজ ১২ আগস্ট আরাফাত রহমান কোকোর ৫৬তম জন্মবার্ষিকী।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.