December 25, 2025, 9:25 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-12-25 19:02:53 BdST

যাওয়া-আসার মাঝে যখন বিস্তর ফারাক


মামলা, নিপীড়নের চিহ্ন, মুচলেকার কানাঘুষা সঙ্গে নিয়ে তারেক রহমান ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেফতার ও মামলার পর জামিনে তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান। সেই যাওয়ায় গ্লানি ছিল, আর দেশে কবে ফিরতে পারবেন— সেটা নিয়েও মনের মধ্যে অনিশ্চয়তা ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে, তাকে দেশ থেকে বাইরে পাঠানো হয়েছিল।

শত অনিশ্চয়তা পার করে দীর্ঘ ১৭ বছরের বাধ্যতামূলক প্রবাস জীবনের পর এই যে তিনি ফিরলেন, সে ফেরা ছিল ঠিক বিপরীত। তিনি লন্ডনে বিমানবন্দরে ওঠার থেকে শুরু করে দেশের বিমানবন্দরে পৌঁছানো পর্যন্ত সব জায়গায় তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ছিল নানা আয়োজন। বিমানবন্দরের বাইরে ছিল সাজানো গাড়িবহর, রাস্তায় ছিল লাখ লাখ নেতাকর্মী-সমর্থক আর ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যেভাবে তাকে চলে যেতে হয়েছিল, সেই যাওয়ার পরে এমন প্রত্যাবর্তনই হওয়ার কথা।

রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন একটাই আলোচনা, ১৭ বছর ধরে বিএনপির নেতাকর্মীরা কেবল তাকে অনলাইনে দেখেছেন। তাদের সামনে এসে তার এই দাঁড়ানোর ফলে বিএনপি দল হিসেবে রাজনৈতিকভাবে আরও সংহত হয়ে উঠবে।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দীন) ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান’ শুরু করে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ— দুই দলের শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই মামলা হয়। তারেক রহমান তখন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমান গ্রেফতার হন। সেই সময় তিনি প্রায় ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন এবং ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য তিনি ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনে যান এবং তারপর থেকে সেখানেই অবস্থান করছিলেন।

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মূলত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ অর্থগ্রহণ, মানিলন্ডারিং, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা ছিল। ২০০৮ সালে যখন জামিন দেওয়া হয়, তখন তাকে দেওয়া দুটো শর্তের কথা শোনা যায়— তিনি রাজনীতি করবেন না, দেশত্যাগ করবেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মামলায় কোনোটাতে সাজা। কোনোটাতে আপিল চলমান ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মনে একটাই প্রশ্ন ছিল— এখনও কেন তারেক রহমান দেশে ফিরছেন না। সবশেষে তিনি জানিয়েছিলেন এটা কেবল তার একক সিদ্ধান্তের বিষয় না।

কেটে গেছে বহুদিন বহুকিছু

তারেক রহমান গত ১৭ বছর কেবল প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন, যা এত সহজ ছিল না। এরমধ্যে একমাত্র ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু হয়েছে, মা খালেদা জিয়া দীর্ঘ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, নতুন মামলায় পড়েছেন, কিন্তু তারেক দেশে ফিরতে পারেননি। কোকোর মৃত্যুর সময় তারেক রহমান লন্ডনেই ছিলেন। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা এবং আইনি বাধার কারণে তিনি মালয়েশিয়া বা বাংলাদেশে এসে ভাইয়ের জানাজা বা দাফনে অংশ নিতে পারেননি। লন্ডনেই তিনি ভাইয়ের জন্য গায়েবানা জানাজা ও দোয়ার আয়োজন করেছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। ১১৭ দিন লন্ডনে অবস্থান শেষে গত ৬ মে তিনি দেশে ফেরেন। এরপর একাধিকবার শারীরিক নানা জটিলতায় তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। গত নভেম্বর মাস থেকে আবারও খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

বন্ধ ছিল বক্তব্য প্রচারও

২০০৮ সালে চিকিৎসার উদ্দেশে লন্ডনে যাওয়ার পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ পর্যন্ত তিনি লন্ডন থেকে বিএনপির রাজনীতিতে পরোক্ষ প্রভাব রেখেছেন। সরাসরি যুক্ততা তেমন দৃশ্যমান না হলেও ২০১৬ সালের পর থেকে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এরপরে বিএনপির কাউন্সিলে তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালে একাধিক মামলায় সাজা ঘোষণার ফলে তারেকের দেশে ফেরা আরও জটিল হয়। এরমধ্যে তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।

আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকা অবস্থায় তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী একটি রিট করেন। পরদিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। তারেক রহমানের কোনও ধরনের বক্তব্য বা বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০২৪ সালের পটপরিবর্তনের পরে রিট আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ সংক্রান্ত রুল খারিজ করে দেন। ফলে তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে বাধা নেই বলে জানান বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল।

এ এক বিপুল ফেরা

বৃহস্পতিবার (২৫ ডিস্বের) সকালে দেশে নেমে বিমানবন্দরের ভেতরে দলীয় শীর্ষনেতাদের আলিঙ্গন করেন তারেক রহমান। এসময় তার চোখে- মুখে আবেগ আর দৃঢ়তার অন্যরকম এক মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। বিমানবন্দরের ভেতরে কিছু সময় কাটিয়ে তিনি বাইরে বের হয়ে এসে প্রথমে জুতা খুলে খালি পায়ে মাটিতে দাঁড়ান, দেশের মাটি হাতে নেন।

শেষবার যেদিন দেশ ছাড়েন, তার আগের রাতও কেটেছে তার হাসপাতালের শয্যায়। দেশ ছাড়ার আগের কয়েক মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সে একটি সাবজেলে তখন বন্দি তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

সেই সময়কার সক্রিয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যঅনুযায়ী, তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদাকে মুক্তি দিতে চাইলে তিনি শর্ত জুড়ে দেন— বন্দি অবস্থা থেকে বড় ছেলে তারেক রহমানকে মুক্তি দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে। এক পর্যায়ে সরকার যাবতীয় ব্যবস্থা করে হাসপাতাল থেকে তারেক রহমানকে ঢাকা বিমানবন্দর নেওয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সে। সেসময় তার কাছ থেকে একটি মুচলেকা নেওয়ার কথাও ছড়িয়ে পড়ে— আর কখনও রাজনীতি করবেন না তিনি। এরপর লন্ডনে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নেন।

১৭ বছর আগে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান যখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লন্ডনে যান, তখন তিনি ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।

এবার ১৭ বছর পরে তিনি ফিরেছেন দেশের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে। প্রথম সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান ফর আওয়ার কান্ট্রি।’’ দেশবাসী, রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা এবং দলীয় জোট সামাজিক যোগাযোগ মাধ‍্যমে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.