রেজাউল করিম চৌধুরী
Published:2025-12-23 15:54:51 BdST
একজন নীতিবান ও প্রভাবশালী পেশাদার হওয়ার যাত্রাপথে
আজ ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক বণিক বার্তায় একটি সংবাদ প্রতিবেদন পড়লাম যার শিরোনাম— "বাংলাদেশি স্নাতকদের দক্ষতা অত্যন্ত নিম্নমানের"। প্রতিবেদনটিতে 'কিউএস ওয়ার্ল্ড ফিউচার স্কিলস ইনডেক্স ২০২৫'-এর রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে পাইকারি হারে কিছু সাধারণ অনুমান করা হয়েছে; বাংলাদেশি স্নাতকদের দক্ষতার স্কোর দেওয়া হয়েছে ৪০-এর কাছাকাছি, যেখানে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির স্নাতকদের সর্বোচ্চ স্কোর দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে আমার ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তবে তা এখন লিখছি না।
প্রতিবেদনের লেখক এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান উচ্চশিক্ষা স্তরে গবেষণায় বরাদ্দ দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাদের তথ্যানুযায়ী, প্রতি ১০০ জনে ২৮ জন স্নাতক বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত। আমাদের উচ্চশিক্ষিতদের একটি বড় অংশ আসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
আমি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে অলাভজনক এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ (MFI) খাতে কাজ করছি, যারা টেকসই ভিত্তিতে 'ক্ষুদ্রঋণ প্লাস' কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমার সংস্থাসহ এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ক্লাসরুম ট্রেনিং বা শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক প্রশিক্ষণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এবং "সাপোর্ট সুপারভিশন" বা সহায়ক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে কর্মকালীন প্রশিক্ষণের চেষ্টা করে।
আমার উপলব্ধি হলো—আমাদের পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একজন নীতিবান ও প্রভাবশালী পেশাদার গড়ে তোলার সংস্কৃতির বড়ই অভাব। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, "ভোগবাদ" এবং "ইন্টারনেট আসক্তি" আমাদের ডুবিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবেষণায় বিনিয়োগ আমাদের আধুনিক করতে পারে এবং উদ্ভাবনের সুযোগ দিতে পারে। কিন্তু আমার মতে, একজন "নীতিবান ও প্রভাবশালী পেশাদার" হয়ে ওঠা মূলত আচরণগত বিষয়, যা পরিবার এবং পিতামাতার কাছ থেকেই শুরু হওয়া উচিত। এই বিষয়ে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা শেয়ার করতে চাই:
সময়ের পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ
এটি মৌলিক একটি বিষয়। আপনি যদি ইউরোপের কোনো পরিবারে যান, তবে রান্নাঘরেই তাদের দৈনিক এবং বার্ষিক পরিকল্পনার চার্ট দেখতে পাবেন। আমি অনেক স্নাতক দেখেছি যারা প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু সেটি তাদের ডায়েরি বা দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক বা বার্ষিক পরিকল্পনা শিটে লিখে রাখেন না।
সময়নিষ্ঠতা
এটি পরবর্তী অগ্রাধিকার। কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে দুই-তিনবার ভাবুন; আপনার সুপারভাইজারের কাছ থেকে সম্ভব হলে অতিরিক্ত সময় চেয়ে নিন। এরপর যেকোনো মূল্যে কাজটি সম্পন্ন করুন এবং সময় সময় আপনার সুপারভাইজারকে কাজের অগ্রগতি জানান। অনেক সময় পেশাদাররা কাজটি করতে ব্যর্থ হন, এমনকি তথ্যও দেন না—যা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার চেইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনের একটি বড় শর্ত থাকে— "পেশাদারকে অবশ্যই সময়সীমা বা ডেডলাইন বজায় রাখতে সক্ষম হতে হবে।"
দলগত কাজ
অনেক তরুণ পেশাদার ব্যক্তিগতভাবে ভালো কাজ করতে পারেন, কিন্তু যখনই তাদের কোনো দলে দেওয়া হয়, তখনই অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুরু করেন। বর্তমানে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো দলগত অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রোডাকশনের ওপর জোর দিচ্ছে। দলগত কাজ ব্যক্তিগত মানবিক সম্পর্ক, মেলামেশা এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
আন্তঃসাংস্কৃতিক ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সহজ দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমানে এটি একটি অপরিহার্য সংস্কৃতি যে, আপনার প্রতিষ্ঠান আপনাকে অন্য কোনো সংস্থা বা এজেন্সির সাথে কাজ করতে পাঠাতে পারে। পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার শুরু থেকেই আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক ও আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সহকর্মীদের বলুন পেশাগত পর্যায়ে নেটওয়ার্কিং করতে, যা তাদের জ্ঞানের উৎস হিসেবেও কাজ করবে।
বর্তমানে অনেক বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করছেন, তাদের সেই ভিন্ন সংস্কৃতি ও জীবনধারা থেকে শিখতে হবে এবং তা উপভোগ করতে হবে। আমি মাঝে মাঝে সহকর্মীদের বলি—আপনাকে যেমন পলিসি মেকারদের প্রভাবিত করতে স্যুট-বুট পরে ফাইভ স্টার হোটেলে যেতে হবে, তেমনি কৃষক এবং ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকদের সাথে দেখা করতে "বটতলায়" যাওয়ার মানসিকতাও থাকতে হবে।
অনুশোচনার মানসিকতা:
আত্মসম্মানবোধ বা ইগো হয়তো প্রয়োজন, কিন্তু অধিকাংশ নতুন স্নাতক অতিরিক্ত ইগো এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভোগেন। সময়ের সাথে সাথে যখন তারা বাস্তবতার মুখোমুখি হন, তখন বুঝতে পারেন এই ইগোই তাদের ক্যারিয়ারের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই ইগোসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুশোচনার মানসিকতা থাকে না; তারা ভুল স্বীকার করতে বা তা সংশোধন করতে চান না। কিছু ধর্ম অনুশোচনার চমৎকার পথ দেখিয়েছে। আমি পেশাদারদের পরামর্শ দেব—অভিজ্ঞ ও সফল কোনো সিনিয়রকে "মেন্টর" হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। প্রতিষ্ঠানেরও উচিত এ বিষয়ে কর্মীদের পরামর্শ দেওয়া।
জনমত গঠন বনাম রাজনৈতিক উস্কানি
মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। আপনার একজন "বস" আছেন যিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। আপনার মতামত নেওয়া তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, কিন্তু অনেক সময় তা ঘটে না। আপনার উচিত বসকে ইতিবাচকভাবে উদ্বুদ্ধ করা যাতে তিনি আপনার মতামত নেন, কিন্তু আপনার পদ্ধতি যেন এমন না হয় যে আপনি বসের বিরুদ্ধে অন্যদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করছেন। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় "হুমকিহীন" (Non-threatening) হতে হবে। মতপার্থক্য মেনে নিন এবং বুঝুন যে বসও অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন অথবা আধুনিক জ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ততটা অবগত নন। অনেক সময় আপনার বস "ব্রেইন ফগ" বা মানসিক অস্পষ্টতায় ভুগতে পারেন, তার মানসিক চাপের প্রতি আপনাকে সহানুভূতিশীল হতে হবে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের অধিকাংশ সময় প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
ব্রেইন রট ও ডিজিটাল ডিটক্স
পরিশেষে, এই দুটি আধুনিক শব্দ নিয়ে আপনার পড়াশোনা করা উচিত। ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি থেকে দূরে থাকা, স্ক্রিন টাইম কমানো এবং সামনাসামনি যোগাযোগ ও পারিবারিক সময় বাড়ানো প্রয়োজন। "ব্রেইন রট" (Brain Rot) মানে হলো—অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের কারণে সৃজনশীলতা, পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারানো। আর "ডিজিটাল ডিটক্স" (Digital Detox) হলো আসক্তি থেকে দূরে থেকে মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানোর প্রক্রিয়া।
নাগরিক বোধ ও শারীরিক সুস্থতা
আপনি কারো বাড়িতে গেলে দেখবেন হোস্ট হয়তো টিভি চালিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তিনি উপলব্ধি করছেন না যে আপনি তাদের সাথে কথা বলতে এসেছেন। বাসে দেখবেন ৯০% যাত্রী মোবাইলে বুঁদ হয়ে আছেন, অথবা কেউ হেডফোন ছাড়াই উচ্চশব্দে গান শুনছেন যা অন্যদের বিরক্ত করছে। অনেক সময় আমাদের নতুন সহকর্মীদের টয়লেট ব্যবহার বা মুখের দুর্গন্ধ দূর করার বিষয়েও প্রশিক্ষণ দিতে হয়। যখন আপনি সকালে ব্যায়াম বা সন্ধ্যায় হাঁটার বিষয়গুলো প্রশিক্ষণে যুক্ত করবেন, অনেকে আপনাকে 'আর্মি পারসন' মনে করতে পারে; কিন্তু শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের প্রতিষ্ঠানে আমরা বিশ্বাস করি, আমরা কেবল আমাদের সংস্থার জন্যই নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশ এবং বিশ্বের জন্য পেশাদার তৈরি করছি—যারা শারীরিকভাবে সুস্থ, সুশৃঙ্খল, উৎপাদনশীল এবং সর্বোপরি একজন নীতিবান মানুষ।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.
