29667

10/03/2025

গ্রুপিংয়েই বিভাজন তৈরি বিএনপিতে

শাহীন আবদুল বারী | Published: 2025-10-02 15:14:18

বিএনপির মূল সম্পদ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁর সততা, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা, স্বাধীন-সার্বভৌম দৃষ্টিভঙ্গী, বহুদলীয় গণতন্ত্র, উৎপাদনমুখী রাজনীতি তাকে অমর করে রেখেছে। ধর্মভীরু ও আধুনিক এই রাষ্ট্রনায়ক আজও প্রাসঙ্গিক। অথচ, তাঁর গড়া দলে চলছে নানা আমদানি করা আদর্শের সংঘাত।

মনে জামায়াত মুখে বিএনপি পরিচয় দেওয়া নেতাকর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ভিও ব্যবসায়ী অশ্লীল ইউটিউবারদের বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। মূলধারায় না ফিরলে এই দলের কপালে আরও দুঃখ আছে। এরকম বাম-ডান করতে থাকলে আরামে দাঁড়ানো হবে না দলটির। চাঁদাবাজি-দখলবাজির অভিযোগ ও দলীয় কোন্দল নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার আশা, দোলনায় বোকার দোল খাওয়ার মতো হতে পারে।

১/১১ এক ভয়াবহ অধ্যায়ে যখন চারদিকে অন্ধকার, অনিশ্চয়তা, ভীতি আর ষড়যন্ত্রে ঘেরা সময়। বিএনপি তখন সবচেয়ে বড় সংকটে। নেত্রী খালেদা জিয়া বন্দি, সংস্কারপন্থীরা দল ভাঙার খেলায় ব্যস্ত। দলের ভেতর-বাইরে সব দিক থেকে চাপ, ভয়ভীতি আর বিশ্বাসঘাতকতার ছোবল। ঠিক সেই সময়ে দলের হাল ধরলেন এক আপসহীন, নির্ভীক, সৎ মানুষ খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তিনি ছিলেন দলের মহাসচিব। শুধু পদ নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিএনপির আত্মা, বিএনপির অবিচল প্রতীক। সংস্কারপন্থীদের মোহে অনেকেই ভেসে গেল, কেউ কেউ ক্ষমতার লোভে নত হল। কিন্তু দেলোয়ার হোসেন ঝড়ের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন—“বিএনপি ভাঙবে না, ভাঙতে দেওয়া হবে না।”

তাঁর কণ্ঠ ছিল দৃঢ়, অবস্থান ছিল আপসহীন। মিথ্যা মামলা, হয়রানি, নির্যাতন কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। সেনা-সমর্থিত সরকারের হুমকি কিংবা লোভ-প্রলোভন কোনোটাই তাঁর চরিত্রকে নষ্ট করতে পারেনি। যখন পুরো দল অচল হয়ে পড়েছিল, তখন তিনি একাই রাস্তায় নেমে সংগঠনকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর দৃঢ়তার কারণে সংস্কারপন্থীদের সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়। বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে শেখে। আজ বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের চিরস্থায়ী প্রেরণা, দলপ্রেম, সততা আর দৃঢ়তা থাকলে এই অন্ধকার সময়েও আলো জ্বালানো সম্ভব হবে।

দলের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, পদবাণিজ্য এবং আওয়ামী দোসর কিছু অসাধু লোক অনুপ্রবেশ করেছে। এরা শুধু দলের ভাবমূর্তিই নষ্ট করছে না, বরং বিএনপির উপর জনগণের আস্থা ধ্বংস করছে। এদেরকে চিহ্নিত করে দল থেকে অব্যাহতি দিলে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়বে। এদের জন্য মাঠের কর্মীরা হারিয়ে যাচ্ছে।

ইদানীং দেশব্যাপী অসাধু নেতারা আওয়ামী দোসরদের যেভাবে লালন-পালন করছে সেটি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবগত আছেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে সূত্র বলছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই দল সংস্কার করা হবে। কিন্তু দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে তেমন কোন আবির্ভাব দেখা যাচ্ছে না। একটি গ্রুপ ভেতরে জামায়াত আর বাইরে বিএনপি বলে শ্লোগান দিচ্ছে। এরা সবাই সুবিধাভোগী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কিছু ভিও ব্যবসায়ী অশ্লীল ভিডিও এবং অশ্লীল কথা রটিয়ে দলের অনেক বড় ক্ষতি সাধন করছে। তাদের উদ্দেশ্য শুধু মাত্র টাকা আয় করা। কেউ গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা করতে চায় না। এর কারণ হচ্ছে, কেউ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শের উপর অনুপ্রাণিত নয়। জিয়ার আদর্শ গড়া দলে চলছে নানা আমদানি করা আদর্শের সংঘাত।

চাঁদাবাজি-দখলবাজি ও দলীয় কোন্দলের সাথে দলের খুব বেশি নেতাকর্মী জড়িত নয়। কিন্তু একটি দলের প্রোপাগান্ডায় জনপ্রিয় এই দলটির বিশ্বজুড়ে বদনাম ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় চাঁদাবাজ-দখলবাজ ও দলীয় কোন্দলের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে অব্যাহতি দিতে হবে যে কোন মূল্যে। নচেৎ ক্ষমতায় যাওয়ার আশা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।

বিএনপির বিভিন্ন সময়ে দেশের মানুষের জন্য যে অবদান আছে তা নস্যাৎ করার জন্য দলের ভেতর ডুবে থাকা কিছু কুলাঙ্গারই যথেষ্ট। এরা আওয়ামী লীগ সরকার আমলে দলের জন্য একটি মিটিং-মিছিলে গিয়েছে; এর কোন নজির নেই। তারাই এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের শেল্টার দিচ্ছে টাকার বিনিময়ে।

ঢাকার পাশেই টাঙ্গাইল জেলা। এই জেলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। সেখানে বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতা ৫ আগস্টের পর আওয়ামী দোসরদের শেল্টার দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা গুলোও অবগত রয়েছে। অর্থলোভী এসব নেতাদের কারণে টাঙ্গাইলে বিএনপির একাধিক গ্রুপের জন্ম হয়েছে। সবাই ছুটছে মনোনয়ন এর পেছনে। সম্মিলিতভাবে টাঙ্গাইলে বিএনপির একটি মিটিং-মিছিলের কোন প্রমাণ নেই। বিএনপির এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জামায়াত এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির উপর জনগণের আস্থা হারানোর জন্য এসব নেতারাই যথেষ্ট বলে সচেতন মহল মনে করেন।

একইভাবে বিএনপির ৩০০ আসনের প্রতিটিতে রয়েছে গ্রুপিংয়ের মহা-উৎসব। বিশেষ করে প্রতিটি আসনে আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে গ্রুপিংয়ের অন্ত নেই। আর এসকল গ্রুপিংয়ে আওয়ামী দোসর, হাইব্রিড ও সুবিধাবাদিরা জায়গা পেয়েছে। কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন বিএনপির ত্যাগী, নিষ্টাবান নেতাকর্মীরা। যারা বিগত ১৭ বছর জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার তাদেরকে মূল্যায়ন করা হচ্ছেনা। যে কারণে জামায়াত খুব নিমিষেই বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পোক্ত করার সুযোগ নিচ্ছে।

নিউ হোপ গ্লোবাল এর চেয়ারম্যান ; মানবাধিকার সংগঠক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক গবেষক ও লেখক ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই বলেন, বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরের বেশি সময় অতিক্রম করে দেশ আজ বৈশ্বিক অঙ্গনে নতুনভাবে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলছে। তবে গণতন্ত্র, অর্থনীতি, শিক্ষা, পরিবেশ ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে আগামী জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নেতৃত্বে। স্বাধীনতার পর দেশের উন্নয়ন ধারাকে নতুন গতি দিয়েছিল। আজও দলটি জাতীয় রাজনীতিতে এক প্রভাবশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। বিএনপি এমন এক সময়ে জন্ম নেয়, যখন দেশের অর্থনীতি, কৃষি ও শিল্পে নতুন প্রাণ প্রয়োজন ছিল। গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ, কৃষির আধুনিকায়ন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার মতো কাজ বিএনপির অবদান হিসেবে স্বীকৃত।

ড. ফয়েজ উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা বিএনপিকে অন্যান্য দলের তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য করে তোলে। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে দলটির নতুন নেতৃত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায় আরও পরিণত ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। বিএনপি কর্মমুখী শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক উদ্যোগ, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং আইটি খাতকে প্রসারিত করার মাধ্যমে তরুণদের জাতীয় সম্পদে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে।

দলটি সবসময়ই বহুদলীয় গণতন্ত্র, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে। নির্বাচনী ইশতেহারেও তারা রাষ্ট্র মেরামতের জন্য ৩১ দফা ঘোষণা করেছে, যা জাতীয় জীবনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের দিশা দেখায়।বিএনপি সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী এবং দেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে ধরে রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দীর্ঘ বিরোধী দলীয় জীবন কাটানোর কারণে মাঠ পর্যায়ের সংগঠনে কিছুটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে।
আধুনিক প্রচার কৌশল (ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার) আরও জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের মাঝে দলীয় ঐক্য ও নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করতে হবে।

অর্থনৈতিক পুনর্গঠন

বাংলাদেশ বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে। সঠিক পরিকল্পনায় বিএনপি কৃষি, শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ও রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিবাচক সম্পর্ক বিএনপি সবসময়ই আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা করেছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মুসলিম বিশ্ব—সব দেশের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করার নীতি বিএনপির অন্যতম শক্তি হতে পারে।

১৬ বছরের বেশি সময় ধরে অনেক তরুণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। বিএনপি যদি তাদের কাছে ইতিবাচক কর্মসূচি তুলে ধরতে পারে তবে এটি হবে একটি বড় শক্তি। সামাজিক ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা,স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি হ্রাস, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ ও মানবাধিকার রক্ষার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব।

বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে। এই বিষয়ে বিএনপিকে আরও সংগঠিত ও কার্যকর মিডিয়া কৌশল নিতে হবে। যুব সমাজ দ্রুত কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি ও আধুনিক শিক্ষায় পরিবর্তন চায়। বিএনপি যদি সময়োপযোগী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে।

জনগণের মাঝে শান্তিপূর্ণ প্রচার অভিযান পরিচালনা করতে হবে । নির্বাচনী ইশতেহার স্পষ্টভাবে প্রচার করা দরকার। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছানো জরুরি। তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক ও উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি। এই শক্তিকে সুসংগঠিত করার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ নেতৃত্ব, স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও জনসমর্থন। বিএনপি তার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেশের জনগণকে একটি ইতিবাচক ভবিষ্যতের দিশা দেখাতে পারে।

বিএনপির শক্তি ও সুযোগ যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান, যা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা যথাযথ নীতি ও নেতৃত্বের মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব।দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য একটি দায়িত্বশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উন্নয়নমুখী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা এখন অপরিহার্য।


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81